নেপাল কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনের মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। সোমবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জনের বেশি নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও সহিংসতার ঘটনায় দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেছে সেনাবাহিনী।
তবে, এই সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার দায় নিতে রাজি নয় আন্দোলনের সূচনাকারী তরুণ প্রজন্ম, যারা নিজেদের ‘জেনারেশন জি’ নামে পরিচয় দেয়। তাদের দাবি, ‘সুবিধাবাদী ও নৈরাজ্যবাদী’ কিছু গোষ্ঠী আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা সহিংস করে তুলেছে। বিবিসিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা স্পষ্টভাবে জানায়—এই ধ্বংসযজ্ঞ তাদের আন্দোলনের অংশ নয়।
‘জেনারেশন জি’ আন্দোলনের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দুর্নীতির অবসান চেয়ে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস উপায়ে আন্দোলন শুরু করেছিলাম। সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করেছি।”
তারা আরও জানায়, বুধবার থেকে নতুন কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচি নেই এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশকে প্রয়োজন হলে কারফিউ কার্যকর করতে অনুরোধ জানিয়েছে তারা।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত দেশজুড়ে কারফিউ বলবৎ থাকবে। এখন পর্যন্ত সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজারাম বাসনেট বিবিসিকে জানান, ‘নৈরাজ্যবাদী ও অপরাধী’ গোষ্ঠীগুলো বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালিয়েছে। সেনাবাহিনী মূলত এসব ব্যক্তিকেই নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিক্ষোভের সূচনা হয় সম্প্রতি সরকারের দেওয়া একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত থেকে—যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভই মূল চালিকাশক্তি। গত কয়েক মাস ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় #NepoKid হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবন ও দুর্নীতির নানা তথ্য ফাঁস করা হচ্ছিল।
সরকার আন্দোলনের চাপে পরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
বিক্ষোভকারীরা মঙ্গলবার কাঠমান্ডুতে নেপালি কংগ্রেস পার্টির সদর দপ্তর এবং দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেওবার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এই অগ্নিকাণ্ডে সুপ্রিম কোর্ট ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব মামলার শুনানি স্থগিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগের পর দেশটিতে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কে হাল ধরবেন, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
তরুণদের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা এমন একটি সরকার চাই, যা দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থ রক্ষায় নয়, বরং সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করবে। আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট—যোগ্য, স্বচ্ছ ও জনমুখী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।”
নেপালের এই তরুণ নেতৃত্ব এখনো আশা করে, তাদের মূল উদ্দেশ্য ও আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই এগিয়ে যাবে—অবশ্য যদি তা আর কোনো পক্ষ ‘হাইজ্যাক’ না করে।